ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ অর্থায়নে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলমান আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন সড়ক প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ দেশে চলে যাওয়ায় এ অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়।
এই প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভারতীয়। কবে নাগাদ কাজ পুনরায় শুরু হবে তা কেউ বলতে পারছে না। এদিকে, সড়কটিকে জায়গায় জায়গায় খানাখন্দ তৈরি হওয়ায় দিন দিন যেন তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। লেগে থাকে দীর্ঘ যানজট। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে করিডোরের অংশ হিসেবে আশুগঞ্জ নদীবন্দরের সঙ্গে আখাউড়া স্থলবন্দরের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থার লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে একটি সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৬ সালে। আট বছরে এসে পাঁচ হাজার ৮৯১ কোটি টাকার এ প্রকল্পটির গড়ে প্রায় ৫৭ শতাংশ কাজও শেষ হয়। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রকল্পটি যেন ‘হোঁচট’ খেয়েছে!
ভারতীয় নমনীয় ঋণ চুক্তির আওতায় আশুগঞ্জ স্থলবন্দর-সরাইল-ধরখার- আখাউড়া চার লেন প্রকল্পটির কাজ এখন বন্ধ হয়ে আছে। সংশ্লিষ্ট ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড’বাংলাদেশের চলমান সার্বিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কথা ভেবে চলে যাওয়ায় প্রকল্পটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এ প্রকল্পে নিয়মিত কাজ করতেন ভারতের এমন ৩৬০ জনের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী । তারা নিজ দেশে চলে যাওয়ার পর কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে। এমনকি এ কাজের জন্য তাদের নির্ধারিত যে কার্যালয় সেখানেও কেউ নেই। ওই কার্যালয় থেকে নিয়মিত যন্ত্রাংশও চুরি হচ্ছে। এদিকে কাজ বন্ধ থাকা অবস্থায় বিকল্প যে সড়ক দিয়ে নিয়মিত যান চলাচল করে সেটি নিয়েও এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই ওই পথ দিয়ে যান চলাচাল অনুযোপযোগী হয়ে পড়ে। এতে যাত্রীসহ চালকেদের ভোগান্তির যেন শেষ নেই।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া ধরখার পর্যন্ত অংশে বেশিরভাগ জায়গায় একদিকে দুই লেনের কাজ শেষ হয়েছে। যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে ওইসব জায়গা খুলে দেওয়ায় অনেকটা স্বস্তি নিয়েই চলা যাচ্ছে। কিন্তু যেসব স্থানে এখনো একদিকেও কোনো কাজ হয়নি এবং একদিকেও কাজ হলেও সড়ক সংযোগস্থলের কাজ বাকি রয়েছে সেসব জায়গা বেশ ভোগান্তি বিরাজ করছে। প্রায়ই এসব স্থানে গাড়ির যন্ত্রাংশ ভেঙে কিংবা দুর্ঘটনা ঘটে আটকে যাচ্ছে। এতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সামান্য একটু বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। প্রকল্পের আওতায় ৫০.৫৮ কিলোমিটার চার লেন সড়ক, ১৬টি সেতু, দু’টি রেলওয়ে ওভারপাস, তিনটি আন্ডার পাস, ১০টি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করার কথা। ২০১৮ সালে শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুন নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে মহামারি করোনা, পণ্যে অপ্রতুলতাসহ নানা কারণে সেটি পিছিয়ে পড়ে।
ভারতীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ২০২২ সাল থেকে প্রকল্পটির কাজ আবার পুরোদমে শুরু করে। এর মধ্যে প্যাকেজ-১ এর অধীনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশুগঞ্জের গোল চত্বর থেকে বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত একপাশে দুই লেনের কাজ পুরোপুরি শেষ করা হয়। প্যাকেজ-২ এর অধীনে বিশ্বরোড থেকে ধরখার পর্যন্ত এক পাশের কাজ অনেকাংশেই শেষ হয়। তবে কাজ চলমান অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর বাইপাস, ঘাটুরা বিরাসার, পৈরতলা, রাধিকা ও উজানিসার এলাকায় মহাসড়কের একপাশে খানাখন্দ থাকায় অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন।
সুলতানপুর এলাকায় কথা হয় বাস চালক মো. আরজ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের এ দুর্ভোগ যে কবে শেষ হবে তা বলা মুশকিল। নানা কারণে এতদিন কাজের দেরি হয়। এখন কিছু কাজ হওয়ার পর শুনেছি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনই চলে গেছে। আমরা চাই সরকার এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিক।
আরেক চালক আলমগীর মিয়া বলেন, এ সড়ক দিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে আমাদের ভোগান্তির শেষ নেই। প্রায়ই যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে মাঝপথে গাড়ি আটকে যাচ্ছে। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে ভোগান্তি আরো বাড়বে।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ভাবছিলাম সড়কটি হলে আমাদের অনেক উন্নতি হবে। কিন্তু এর কাজই শেষ হওয়ার নাম নেই। এতে ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরা। ধুলাবালির কারণে চলাচল করা কষ্টকর।
আশুগঞ্জ-আখাউড়া ফোর লেন প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. শামীম আহমেদ জানান, ভারতীয়রা নিরাপত্তার কথা বলে দেশে চলে গেছেন। তাদের সাড়ে তিনশ’র বেশি লোকের একজনও এখানে নেই। কবে তারা ফিরে আসবেন এ বিষয়েও কিছু জানায়নি।
তিনি আরো জানান, প্যাকেজ-১ এর আশুগঞ্জ থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত মহাসড়কের ৬২ শতাংশ এবং বিশ্বরোড থেকে ধরখার বাজার পর্যন্ত ৫২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ যেহেতু ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ছিল, সেহেতু বিকল্প সড়ক মেরামতের দায়িত্বও তাদের। এখন ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন না থাকায় কিছু করাও যাচ্ছে না।
Leave a Reply