টিকে থাকার লড়াইয়ে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
কুলিয়ারচরের কুমারপাড়ায়
নাজির আহমেদ আল-আমিন
একসময় ঘরে ঘরে তৈরি হতো মাটির হাঁড়ি, পাতিল, রঙিন খেলনা। এখন সেই দৃশ্য শুধুই স্মৃতির অংশ। প্লাস্টিক, মেলামাইন আর স্টিলের পণ্যের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের মৃৎশিল্প। তবুও বাংলা নববর্ষ ঘিরে প্রাণ ফিরে পেয়েছে উপজেলার দোয়ারীয়া গ্রামের কুমারপাড়া। দিনভর চলছে খেলনা বানানো, শুকানো আর রঙ করার কাজ। আবারও ভরসা খুঁজছেন মাটির শিল্পীরা।
এই কাজ করতে করতে জীবন পার, তবু বাঁচাতে পারিনি শিল্পটা- প্রবীণ মৃৎশিল্পী ৬৫ বছরের মৃৎশিল্পী নুরুল ইসলাম বলেন, ছোটবেলা থেকে এই কাজ করে আসছি। নববর্ষ ছাড়া তেমন কাজ নেই। নতুন কিছু করতে চাই,কিন্তু টাকা-পয়সা নাই। ছেলে-মেয়েরা আর শেখে না।
কারিগর সাগর ধর পাল জানান, এপেশায় এখন আর সংসার চলে না। বাপদাদার পেশা আর অবসর সময় কাটাতে এখনো এপেশার কাজ করছি।
কারিগর মানিল পাল, প্লাস্টিক সামগ্রী বের হওয়ার পর এখন মাটির খেলনা বাজারে তেমন চলে না এবং দামও কমে যাওয়ায় তেমন মুনাফা নেই।
মনুরঞ্জন পাল বলেন, বলেন, বৈশাখী মেলায় এসব খেলনা বিক্রি করলে ৩/৪ হাজার টাকা মুনাফা হতে পারে। এই মুনাফায় সন্তানদের লেখাপড়া খরচ কোনো রকম চলে।
লক্ষী রানি পাল বলেন, এক সময় মাটির কাজ পেশা হিসেবে করলে এখন আর পেশা হিসেবে এই কাজ করিনা। তবে বাড়িতে অলস সময় কাটাতে আর নিজের ব্যয় মেটাতেই মাটির খেলনা তৈরি করি।
পেশার বাইরেও প্রতি বছর আমরা মাটির খেলনা তৈরি করি বলেই বাংলার ঐতিহ্য টিকে আছে। পাশাপাশি শিশুরা এসব খেলনা কিনে আনন্দ করে।
এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মো. ছোটন মিয়া জানান, আধুনিকতার ভীড়ে পেরে উঠছেন না মাটির কারিগররা। আগে মাটির তৈরি দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে আধুনিক সামগ্রী ব্যবহারের ফলে মৃৎশিল্প কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এরপরও বাপ-দাদার এই পেশা ধরে রেখেছে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার।এছাড়াও রয়েছে তাদের পুঁজির অভাব। সব মিলে ভালো নেই তারা।
গ্রামের বাজারে খোঁজ নিলে দেখা যায়, পুতুল, ঘোড়া, গরু-মাটির খেলনাগুলো সাজানো আছে চাটাইয়ের উপর। বিক্রি হচ্ছে কম, কিন্তু আগ্রহ আছে শিশুদের মাঝে।
এ বিষয়ে কুলিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিহা ফাতেমা তুজ জহুরা বলেন, বর্তমান সময়ে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মাটির তৈরির জিনিস তেমন বিক্রি হয়না। যার কারণে এই শিল্পের সাথে যারা জড়িত তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিসম্মুখীন হচ্ছেন। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ও তাদের জন্য কিছু করা যায় কিনা এবং তাদের জীবিকার পরিবর্তন করা যায় কিনা উপজেলা প্রশাসন দেখবে।
মাটি, মানুষ ও মায়া এই শিল্প শুধু অর্থনীতি নয়, আত্মপরিচয়ের প্রতীক। তাই প্রয়োজন একযোগে সরকারি, সামাজিক ও ব্যক্তি উদ্যোগ। কেবল পৃষ্ঠপোষকতা নয়—নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করাও জরুরি।
যদি আমরা চাই, আমাদের সন্তানরাও যেন জানে, কীভাবে মাটি দিয়ে জীবন গড়া যায়—তাহলে এখনই সময়, ঐতিহ্যকে পুনর্জাগরণের।
Leave a Reply