মুনাফার লোভে সর্বস্বান্ত!৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালাল চাঁনপুর মাল্টিপারপাসের মালিক
নাজির আহমেদ আল-আমিন,ভৈরব
হাতে বিভিন্ন ব্যাংকের কয়েকটি চেক নিয়ে একটি অফিসের সামনে বসে আছেন রোকেয়া বেগম। তার পাশে কেউ বসে, কেউ দাড়িয়ে আছে আবার কেউ কেউ হাহাকার করছে। আর এদিক ওদিক জড়ো হয়েছে শতাধিক লোকজন।আবার মাটিতে লুটিয়ে কান্নায় একাকার করছে আরেক এক মহিলা। এমনি চিত্র দেখা গেছে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের চাঁনপুর এলাকার চানপুর বাজারে।
সরেজমিনে দেখে জানাযায়, চাঁনপুর বাজারে চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান কিছু মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে কয়েকশত গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে গ্রাহকদের প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে। এমনি অভিযোগ শতশত গ্রাহকদের।
ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানায়, ২০১০ সালে ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের চাঁনপুর চক বাজারে প্রধান কার্যালয় গড়ে তোলে চাঁনপুর এলাকার মো: শাহআলম মিয়া চানঁপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যার কাজ হচ্ছে সঞ্চয় করা, ঋণ প্রদান। এছাড়া অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে বড় অংকের টাকা সংগ্রহ করা। তাই গ্রাহকরা যার যার মতো করে যেকোন উপায়ে এই প্রতিষ্ঠানে অধিক মুনাফার লোভে টাকা পয়সা, স্বর্ণাঅলংকার জমা রাখতেন।পরে ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ সুযোগ বুজে সকল টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায়।
প্রশাসন বলছে, সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন নেওয়া এ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হয়ে পথে বসেছেন উপজেলার চাঁনপুর গ্রামের শতাধিক গ্রাহক।গ্রাহকদের অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শবনম শারমিন।
আরও জানাযায়, সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত ও প্রতি লাখে দুই হাজার টাকা মুনাফা দিবে মাস শেষে এমন প্রলোভন দেখিয়ে একই গ্রামের শাহ আলম মিয়া মানুষ জনের কাছ থেকে টাকা নেন। প্রতি মাসে ব্যবসায়িক মুনাফা পাওয়ায় অনেকে প্রবাসে আয় করা টাকা, জমি বিক্রির টাকা এমন কি অন্যান্য ব্যাংকে রাখা টাকাও উত্তোলন করে বিনিয়োগ করেন চাঁনপুর মাল্টিপারপাস নামের এই সময়বায় সমিতিতে। এছাড়া চাঁনপুর গ্রামের মসজিদ কমিটির সভাপতি ও একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় সবাই তাকে বিশ্বাসও করেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে গ্রাহকের কাছ থেকে একেক অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। এসব টাকা নেয়ার সময় সবার হাতেই একাধিক ব্যাংকের চেক ধরিয়ে দেন। এসব চেকের মাধ্যমে প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে রাতের আধারে স্ত্রী-সন্তার নিয়ে পালিয়ে গেছেন।
উধাও মালিক ও ভুক্তভোগীদের বিক্ষোভ
চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে লাপাত্তা হয় চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের স্বত্বাধিকারী মো. শাহ আলম। এমন সংবাদ পেয়ে চাঁনপুর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সামনে এসে জড়ো হয় ভুক্তভোগী গ্রাহকসহ এলাকার লোকজন।পরে তারা প্রতারক শাহ আলমের বাড়িতে গেলে জানতে পারেন সেটি এক প্রভাবশালীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এতে আরও নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন শতাধিক গ্রাহক।
দানু মিয়া নামে এক গ্রাহক বলেন, সমিতির কার্যক্রম শুরুর পর ভালই চলছিল। গ্রাহকদের পাওনা মুনাফা সময়মত পরিশোধ করা হতো। আমার আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন গ্রাহক থেকে প্রায় ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা নিয়েছে।
রোকিয়া বেগম নামে আরেক গ্রাহক বলেন, আমার ছেলে সৌদি প্রবাসী। জীবনের সঞ্চয় করা ৩০ লাখ টাকা ও কয়েক ভরি স্বর্ণাঅলংকার বিনিয়োগের পর কয়েক মাস একটা লভ্যাংশ পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সব কার্যক্রম বন্ধ করে সমিতির লোকজন পলাতক। আমার আরেক ছেলে সার্বিয়া যাওয়ার কথা তার ভিসাও এসে গেছে। আমার বড় ছেলের জমানো টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা কিছুদিনের মধ্যে দেওয়ার কথা ছিলো ছোট ছেলে বিদেশে যাওয়ার জন্য জমা দিবে বলে। কিন্তু এর মধ্যে সে সমিতির লোক পালিয়ে গেছে। আমি এখন পথে বসে গেছি। শেষ হয়ে গেছি।
আরেক গ্রাহক শফিক মিয়া বলেন, আমার নিজের ও দুই বোনের মিলিয়ে মোট ৯ লাখ টাকা জমা রেখেছিলাম এই সমিতিতে।বর্তমানে সমিতির কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না, কার্যালয়ও তালাবদ্ধ। এছাড়া আরও অনেক গ্রাহক রয়েছে যারা স্বামী সন্তানের ভয়ে সামনে আসছেনা। তারাও ঐ প্রতিষ্ঠানে তাদের স্বামী সন্তানের জমানো সঞ্চয় জমা রেখেছে।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ও আইনগত ব্যবস্থা
ভৈরব উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা রুবাইয়া বেগম জানান, ২০১০ সাল থেকে সমিতিটি পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে নিয়মিত অডিটের সময় এই সমিতি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এমন কোনো অনিয়ম বা অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এখন অভিযোগ এসেছে, তারা কার্যক্রম বন্ধ করে পালিয়ে গিয়েছে। যদি গ্রাহকরা অভিযোগ দেই তাহলে সমিতির সদস্য বা গ্রাহকদের দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে জেলা কার্যালয়ে প্রতিবেদনে পাঠানো হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জন্য। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সমিতির নিবন্ধন বাতিল করাসহ সমিতির ম্যানেজিং কমিটির অনন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ এর আইনে মামলা গ্রহণ করা হবে।
ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শবনম শারমিন বলেন, সমবায় সমিতির কার্য নির্বাহী কমিটির সভাপতির মাধ্যমে এলাকাবাসী যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সে ক্ষেতে যেহেতু এটি প্রতারণা, মামলাটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হয়। কোনো ভুক্তভোগী স্বপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে মামলা দায়ের করেন তাহলে আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগীতা প্রধান করা হবে। তাছাড়া সমবায় সমিতিটি যেহেতু সরকারি ভাবে নিবন্ধিত এবং ঘটনাটি সভাপতি মাধ্যমে ঘটেছে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে সেক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের মাধ্যমে আমরা প্রশাসনিক ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
Leave a Reply