ভৈরবে ছিনতাইয়ের তাণ্ডবে আতঙ্কিত জনজীবন: ব্যবসায়ী ও পথচারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে
নাজির আহমেদ আল-আমিন,ভৈরব
কিশোরগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী ভৈরবে ছিনতাইয়ের ঘটনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আগে সন্ধ্যার পর এমন অপরাধের ঘটনা ঘটলেও এখন দিনে-দুপুরে প্রকাশ্য রাস্তায় ছিনতাই হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ী, পথচারী, ও দূর-দূরান্ত থেকে আগত যাত্রীরা সবসময় আতঙ্কে থাকছেন। শহরজুড়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় সুশীল সমাজ, স্থানীয় বাসিন্দা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের শহর এখন ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য ভৈরব, যা দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং রেল, নৌ, ও সড়কপথে একটি ব্যস্ত হাব, সেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ যাতায়াত করেন। এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এসব চক্রের অধিকাংশ সদস্য ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণ। নগদ টাকা, মূল্যবান মোবাইল, এবং অন্যান্য সম্পদ ছিনিয়ে নিতে তারা ধারালো দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করছে। সামান্য বাধা দিলেই পথচারী এবং ভুক্তভোগীদের গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি কর।
দেখা যায়, শহরের বেশ কিছু এলাকা ছিনতাইকারীদের ‘নিরাপদ জোন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এসব এলাকার মধ্যে রেল স্টেশন সড়ক, পলাশের মোড় থেকে পৌর কবরস্থান, নাটাল মোড় থেকে ফেরিঘাট, রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রেলওয়ে কলোনি মন্দির, মেঘনা তেলের ডিপো থেকে মনামরা ব্রিজ, ভৈরব বাজারের হলুদপট্টি থেকে লালপুর ঘাট, বাসস্ট্যান্ড এলাকার আশেপাশসহ, প্রয়াত রাষ্টপতির বাড়ির সামনে থেকে নদী বাংলা সেন্টার পর্যন্ত। এবং উপজেলা পরিষদ থেকে শম্ভুপুর রেলগেট উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও শহরের অন্ধকারাচ্ছন্ন অলি-গলিগুলো ছিনতাইকারীদের জন্য আদর্শ স্থান হয়ে উঠেছে। এসব এলাকায় প্রতিদিন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ভুক্তভোগী পুলিশি হয়রানির ভয়ে থানায় অভিযোগ করতে চান না।
ফেরিঘাট মিনা বাজারের তরকারি ব্যবসায়ী আল-আমিন বলেন,আমরা ফেরিঘাটের তরকারি ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন সকালে নারায়নপুর, বারৈচা থেকে শাকসবজি কিনতে হয়। কিন্তু প্রায়ই আসা যাওয়ার সময় সিরাজ নগর মসজিদ এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে হয়। এসময় ব্যবসার টাকা পয়সা ও মোবাইলগুলো তাদের কাছে দিয়ে আসতে হয়।
শহরের একজন ব্যবসায়ী আব্দুল করিম বলেন, “আমরা এখন নগদ টাকা নিয়ে চলাফেরা করতে ভয় পাই। দোকান বন্ধ করার পর টাকার ব্যাগ নিয়ে বাসায় ফেরার সময় সবসময় আতঙ্ক কাজ করে। প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বড় প্রভাব পড়বে।”
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “আগে সন্ধ্যার পর ছিনতাই হত, এখন দিনে-দুপুরেও ছিনতাইকারীদের তাণ্ডব চলছে। বিশেষ করে রেলস্টেশন এলাকায় চলাফেরা করতে ভয় লাগে।”
ভুক্তভোগী একটি গাড়ি ট্রেনিং সেন্টারের ছাত্র বলেন, “নাটাল টোল প্লাজা ও সিরাজ নগর মসজিদ এলাকায় দুপুর বেলা রিকশায় করে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীরা মোবাইল আর টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। থানায় অভিযোগ করলেও এখনো কিছু হয়নি।”
রেলওয়ে স্টেশনের যাত্রীরা জানায়, ভোর বেলায় যখন আমরা ট্রেন ধরার জন্য যখন স্টেশনে যাই, তখনই পলাশের মোড় না কবরস্থানের সামনেই ধারালো অস্ত্রসহ ছিনতাইকারীরা আমাদের এটাক করে। পরে বাধ্য হয়েই তাদেরকে সবকিছু দিয়ে দিতে হয়।
আরেক যাত্রী বলেন,ছিনতাইকারীরা প্রথমে এসেই আমাদের শরীরের যেকোন জায়গায় আঘাত করে। যার কারণে বাধ্য হয়েই সবকিছু দিতে হয়।
শহরের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মোহাম্মদ সোহেলুর রহমান বলেন, “ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ঘাটতি প্রকাশ করছে। এটা শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।”
পৌর এলাকার এক শিক্ষক বিল্লাল হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত আতঙ্কে আছে। সন্ধ্যার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশেপাশেও ছিনতাই হচ্ছে। এটি দ্রুত বন্ধ করা দরকার।”
স্থানীয়রা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, ছিনতাইয়ের এ ধরণের অপরাধ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
ভৈরবে ছিনতাই প্রতিরোধে ভৈরব থানা, হাইওয়ে পুলিশ, রেলওয়ে থানা, র্যাব-১৪ এবং নৌ-পুলিশসহ একাধিক বাহিনী কাজ করছে। থানার ওসি মোহাম্মদ শাহিন জানান, গত দুই মাসে ২০০ জনেরও বেশি ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তারা পুনরায় একই অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শহর এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তবে অপরাধ পুরোপুরি বন্ধ করতে প্রয়োজন স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা।
ভৈরবের ছিনতাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজন নিয়মিত নজরদারি, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি। সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতার মাধ্যমে ছিনতাই প্রতিরোধ সম্ভব। প্রশাসন দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ভৈরব পুনরায় শান্তিপূর্ণ বাণিজ্য নগরীতে রূপান্তরিত হবে বলে প্রত্যাশা সকলের।
Leave a Reply