একই মালিকের একাধিক সংবাদমাধ্যম নয়: গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন
দৃশ্যপট নিউজ ডেস্ক
এক মালিকের একাধিক সংবাদমাধ্যম না রাখা এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষায় নতুন আইনের সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। শনিবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে সংস্কার সুপারিশের প্রতিবেদন জমা দেন কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ।
পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের প্রস্তাব এবং গণমাধ্যম মালিকানার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের সুপারিশ তুলে ধরেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং সংস্কার কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা** উপস্থিত ছিলেন।
গণমাধ্যম মালিকানায় পরিবর্তন আনার সুপারিশ
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, একই মালিকের একাধিক সংবাদমাধ্যম থাকা উচিত নয়। গণমাধ্যমের মালিকানা বিভাজন না হলে সাংবাদিকতা ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি তৈরি হতে পারে।
তিনি বলেন,
একজন মালিক টেলিভিশন, সংবাদপত্র, রেডিও বা অনলাইন একসঙ্গে রাখতে পারবেন না।
একটি প্রতিষ্ঠান মালিকানাধীন একাধিক সংবাদমাধ্যম থাকলে, একটি বেছে নিতে হবে বা অন্যগুলোর মালিকানা হস্তান্তর করতে হবে।
সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি ধরে রেখে বাকিগুলো একীভূত করার প্রক্রিয়া চালাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশে এমন নিয়ম কার্যকর রয়েছে। বাংলাদেশেও এটি বাস্তবায়ন করা জরুরি।
সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রস্তাব
সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে **‘সাংবাদিক সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের সুপারিশ করেছে কমিশন।
প্রস্তাবিত সুরক্ষা আইনের মূল দিকগুলো:
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিধান করা হবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সরকার সাংবাদিকদের ফোন তল্লাশি করতে পারবে না।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা বা হয়রানি বন্ধে বিশেষ আইনি সুরক্ষা থাকবে।
সাংবাদিকদের কোনো সংবাদ প্রকাশের কারণে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
কমিশন জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইতোমধ্যে এ ধরনের আইন কার্যকর হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানেও এমন আইন পার্লামেন্টে বিবেচনাধীন।
—
সরকারি সংবাদমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসনের সুপারিশ
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন সম্প্রচার সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রস্তাব অনুযায়ী—
বিটিভি ও বেতার একটি স্বাধীন সম্প্রচার সংস্থার অধীনে পরিচালিত হবে।
বাসস (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা) কে এই সংস্থার নিউজরুম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এর ফলে সরকারি সম্পদের অপচয় কমানো যাবে এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।
সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য নতুন কাঠামো
কমিশন সাংবাদিকদের বেতন কাঠামো নির্ধারণে নতুন নিয়ম চালুর সুপারিশ করেছে।
মূল সুপারিশ:
সাংবাদিকতার এন্ট্রি-লেভেলের বেতন বিসিএস নবম গ্রেডের সমান হতে হবে।
সারা দেশে এই কাঠামো কার্যকর করা হবে, তবে ঢাকায় সাংবাদিকদের জন্য আলাদা ভাতা থাকবে।
নিয়োগের আগে এক বছরের শিক্ষানবিশকাল বাধ্যতামূলক করতে হবে।
ওয়েজবোর্ড নিয়ে চলমান মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
সাংবাদিকদের বিজ্ঞাপন এজেন্ট হিসেবে কাজ নিষিদ্ধ
গণমাধ্যমের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কমিশন সাংবাদিকদের বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত কাজে জড়িত হওয়া নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে।
কমিশন বলেছে—
সাংবাদিকদের মূল দায়িত্ব সাংবাদিকতা করা, বিজ্ঞাপন এজেন্ট হিসেবে কাজ করা নয়।
বিজ্ঞাপন ও সাংবাদিকতা আলাদা রাখার জন্য পৃথক নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
সরকারি বিজ্ঞাপনে অনিয়ম ও সংবাদপত্রের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন
সরকারি ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্মস অ্যান্ড পাবলিকেশনস (ডিএফপি) এর তথ্য বিশ্লেষণ করে কমিশন বিশাল অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে।
কামাল আহমেদ বলেন—
সরকারি হিসাবে প্রতিদিন ঢাকায় ১.৫১ কোটি সংবাদপত্র ছাপা হয়, তবে বাস্তবে এ সংখ্যা ১০ লাখের বেশি নয়।
অতিরিক্ত সংখ্যা দেখিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন সুবিধা নেওয়া হচ্ছে।
সরকারি তালিকায় ৬০০টির বেশি সংবাদপত্র থাকলেও বাস্তবে মাত্র ৫২টি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
কমিশন সুপারিশ করেছে—
সংবাদপত্রের প্রকৃত সংখ্যা যাচাই করতে স্বাধীন কমিটি গঠন করা হোক।
সরকারি বিজ্ঞাপন শুধুমাত্র প্রকৃত মুদ্রিত সংবাদপত্রের জন্য বরাদ্দ করা উচিত।
টেলিভিশনের টিআরপি (TRP) রেটিংয়ের অনিয়ম দূর করার সুপারিশ
টেলিভিশন চ্যানেলের টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুতর অনিয়মের কথা উল্লেখ করেছে কমিশন।
মূল সমস্যা:
টিআরপি নির্ধারণের জন্য ৮,০০০ ডিভাইস বসানোর কথা থাকলেও, বাস্তবে মাত্র ২০০ ডিভাইস বসানো হয়েছে।
সম্প্রতি ১০০টি নতুন ডিভাইস বসানো হলেও, তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
টিআরপি যাচাই শুধু সরকার বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নয়, তৃতীয় পক্ষকেও করতে দিতে হবে।
এই তৃতীয় পক্ষ হবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রকাশ করা হবে অনলাইনে
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তাদের ১৮০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন অনলাইনে উন্মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে।
কমিশন বলেছে
যে কেউ চাইলে পুরো প্রতিবেদন পড়তে পারবেন।
প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, কীভাবে গণমাধ্যমকে আরও স্বাধীন, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করা যায়।
কমিশনের সদস্যরা
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ তৈরিতে কাজ করেছেন ১১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তারা হলেন—
কামাল আহমেদ (প্রধান)
অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন
সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ
মাছরাঙা টেলিভিশনের অঞ্জন চৌধুরী
নোয়াবের সচিব আখতার হোসেন খান
সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমেদ
যমুনা টিভির ফাহিম আহমেদ
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের টিটু দত্ত গুপ্ত
সাংবাদিক জিমি আমির
ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ
শিক্ষার্থী প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল মামুন
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে **গণমাধ্যমের মালিকানায় স্বচ্ছতা আসবে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বাড়বে এবং সংবাদপত্র ও টেলিভিশন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে**।
Leave a Reply