“ভৈরবে এক পরিবারের চারজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু: থানায় মামলা দায়ের “
নিজস্ব প্রতিবেদক
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ভাড়া বাসা থেকে জনি বিশ্বাস ও নিপা রানী মল্লিক দম্পতি ও তাঁদের দুই শিশুসন্তানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে গেল ২৮ নভেম্বর মঙ্গলবার বিকেলে। এই ঘটনায় ভৈরব থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলাটি করেছেন জনির মা শিখা রানী বিশ্বাস।
পুলিশ এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন কাউকে আটক করতে পারেনি। তবে জনির সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে সাবলেট নিয়ে বসবাস করা কার্তিক বর্মণ ও সৃষ্টি রানী বর্মণ দম্পতিকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। চার মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে কার্তিক-সৃষ্টি দম্পতি ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করছেন। কার্তিক ভৈরবের একটি ডালের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনি বিশ্বাসের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের আনারাবাদ গ্রামে। বাবার নাম গৌরাঙ্গ চন্দ্র বিশ্বাস। জনি আট বছর ধরে স্ত্রীকে নিয়ে ভৈরবে বসবাস করে আসছিলেন।
স্বজনেরা জানান, ভৈরব বাজারের বাগানবাড়ি এলাকায় মিজান মিয়ার ওয়ার্কশপে হেডমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন জনি। ৯ বছর আগে গাজীপুরের নির্মল মল্লিকের মেয়ে নিপা রানী মল্লিককে বিয়ে করেন তিনি। জনি-নিপা দম্পতির দুই সন্তান ধ্রুব ও কথা। ধ্রুব স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। নিপা আবারও অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন।
জনি-নিপার স্বজনেরা জানান, গেল রবিবার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে জনি গ্রামের বাড়িতে যান। পরদিন সোমবার ফিরে আসেন। জনি সকাল ১০টার মধ্যে ওয়ার্কশপে কাজে যেতেন। একই ওয়ার্কশপে কাজ করেন জনির আপন মাসতুতো (খালাতো) ভাই ঝোটন প্রামাণিক। গতকাল সকাল ১০টা পেরিয়ে গেলেও কাজে না আসায় ওয়ার্কশপের মালিক মিজান মিয়ার নির্দেশে ঝোটন যান জনিকে ডেকে আনতে। অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা না খোলায় ফিরে আসেন। আবার যান বেলা আড়াইটায়। তখনো দরজা না খোলায় ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে যান। পরে দরজার চৌকাঠের একটি ছিদ্র দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখতে পান জনির মরদেহ ঝুলছে। এ সময় পাশের কক্ষেই ছিলেন সাবলেট প্রতিবেশী সৃষ্টি বর্মণ।
ঝোটন প্রামাণিক বলেন, ‘আমরা দুবার ডাকলাম। কারও কোনো সাড়া পেলাম না। সাবলেটে থাকা পরিবারের সদস্যরাও আমাদের ডাকে সাড়া দেননি। শেষে ধাক্কা দিয়ে ঘরের প্রধান দরজা খুলে ভেতরে যাওয়ার পর সৃষ্টি রানীর দেখা পাই। বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছি।
ঝোটন প্রামাণিক বারবার ডাকার পরও সাড়া না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সৃষ্টি রানী বলেন, সোমবার জনি ও নিপা গ্রামের বাড়ি থেকে বাসায় আসেন সন্ধ্যার দিকে। তখন আমরা বাসায় ছিলাম। কিছুক্ষণ পর একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমরা চলে যাই। ফিরে আসি ভোরে। এসে দেখি, জনি-নিপার রুমের দরজা বন্ধ। আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে আমার স্বামী কাজে চলে যায়। তখনো দরজা বন্ধ পাই। আমিও সবজি কিনতে বাইরে যাই। বেলা ১১টার পর ঘরে এসে রান্নাবান্না করি এবং দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। কখন কীভাবে এ ঘটনা ঘটল, আমরা টের পাইনি।’
সৃষ্টি রানী আরও জানান, তাঁরা দুই পরিবার ঘরে ঢোকে এক দরজা ব্যবহার করে। ভেতরে গিয়ে পৃথক কক্ষে থাকেন। কিছুদিন ধরে মূল দরজার ছিটকিনি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খোলা রেখেই থাকতে হচ্ছিল। গতকাল ভোরে ঘরে এসে দেখতে পান, জনি-নিপার ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো।
সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে গতকাল বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে প্রথমে নিপা ঘরে ঢোকেন। ১৮ মিনিট পর ৫টা ৩৮ মিনিটে আসেন জনি। সকালে কার্তিক ও সৃষ্টি বের হয়ে যাওয়ার পর বেলা ১১টা ২৪ মিনিটে ঘরে ফিরে আসেন সৃষ্টি। বেলা ১টা ৩৭ মিনিটে ঘরে আসেন কার্তিক।
ভৈরব বাজারের বিপুল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে চার বছর কাজ করেছেন জনি। দেড় বছর আগে এই ওয়ার্কশপ ছেড়ে চলে যান। জনি সম্পর্কে মালিক বিপুল বর্মণ বলেন, ‘আমি জনিকে ১৭ হাজার টাকা বেতন দিতাম। অর্থের বিশেষ প্রয়োজন আছে, এমন কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে কখনো কথা বলেনি। স্ত্রীকে নিয়ে ঝামেলায় আছে, এই রকম কথাও তার মুখ থেকে বের হয়নি।
জনির ছোট ভাই পলাশ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে হচ্ছে, ঘটনাটির পেছনে অন্য ঘটনা থাকতে পারে। এ জন্যই হত্যা মামলা করেছি।’
এদিকে এক পরিবারের চারজনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী। এ ছাড়া র্যাব, ক্রাইম সিন ও পিবিআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
মামলাটি তদন্ত করছেন ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শাহিন। তিনি বলেন, হত্যা মামলা হয়েছে। আমরা নানা দিক মাথায় রেখে তদন্ত করছি।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, আমাদের তদন্তে কিছু মানুষের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, জনি নেশা করতেন। তবে ঘটনার সঙ্গে নেশার সম্পর্ক রয়েছে কি না, নিশ্চিত নই।
Leave a Reply