ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের পথশিশুদের সংগ্রামমুখর জীবন
নাজির আহমেদ আল-আমিন,ভৈরব
কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন শুধুমাত্র একটি যাত্রাবিরতির স্থান নয়, এটি কিছু পথশিশুর আশ্রয়স্থলও। এখানে প্রতিদিন দেখা যায় এমন শিশুদের, যাদের নেই কোনো স্থায়ী বাসস্থান বা পরিচয়। এই শিশুরা বঞ্চিত পরিবারের সন্তান, যারা সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক কঠিন ও অনিশ্চিত জীবনের সাথে সংগ্রাম করছে।
পথশিশুরা সাধারণত এমন পরিবার থেকে আসে, যাদের জীবন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে আবদ্ধ। ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের আশেপাশে তাদের প্রতিদিনের জীবন কাটে খাবারের জন্য সংগ্রাম করে। কেউ কেউ ভিক্ষা করে, কেউ বা ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে কাগজ, বোতল বা অন্যান্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী সংগ্রহ করে। তাদের অধিকাংশেরই জন্মের কোন নিবন্ধন নেই, ফলে আইনত তাদের কোনো পরিচয় নেই।
পরিচয়হীন ও শিক্ষাহীন এই শিশুরা অপরাধ জগতে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। চুরি, ছিনতাই, মাদক বিক্রি ইত্যাদি কাজের সাথে জড়িয়ে পড়া যেন তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা নিয়মিত নেশার দ্রব্য সেবন করে, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। রেলস্টেশনের আশেপাশের অপরাধ চক্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে তারা, যেখানে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে।
এই শিশুদের জীবনে স্বপ্ন বা আশার আলো প্রায় অনুপস্থিত। না আছে তাদের শিক্ষার সুযোগ, না আছে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার কোনো নিশ্চয়তা। বেশিরভাগ সময়ই তারা সমাজের চক্ষু আড়ালে থেকে যায়, আর তাদের সমস্যাগুলো অবহেলিতই থেকে যায়।
রেলওয়ে স্টেশনের দোকানদারা বলছে ,৭-১০ বছর বয়সী বাচ্ছারা এখানে বসবাস করছে। তারা কোথায় থেকে আসলো তা কেউ জানে না। দোকানদার আরও জানায়, তারা যাত্রীদের অনেক বিরক্ত করে। আবার দেখা যায় স্টেশনে যাত্রী বা সাধারন পাবলিক বসে বা শুয়ে থাকলে তারা সুযোগবুজে জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে বিক্রি করে নেশা করে ।
কথা হয় রেলওয়ে স্টেশনে বসবাসকৃত কয়েজন বাচছা ছেলেদের সাথে, ৭ বছর বয়সী এক শিশু বাচ্ছা বলে তার মা,বাবা এই রেল স্টেশনেই ট্রেনের নিচে পড়ে মরে যায়্ তাই এই স্টেশনেই শিশুকাল থেকে এই পর্যন্ত বড় হয়েছি । কখনো টাংকির নিচে বা প্লাটফর্মের বেঞ্চে ঘুমায় ।
আরেক শিশু জানায় ট্রেন আসলে যাত্রীদের কাছ টাকা তুলে তারা খাবার খায়। আবার তারা জুতার পেস্টিং খেয়ে নেশা করে।
দেখাযায় এদের মধ্যে কয়েকজন বাচ্ছারা সাধারন শিশুদের মতো বাচতেও ইচ্ছা জানায়। তারা বলে আমাদের কেউ এই উপকারটা করেন, আমরা স্কুলে যেতে চাই, ভালো ভালো পোশাক ও খাবার খেতে চাই। আমাদের নতুন একটা জীবন চাই।
স্থানীয় সুশীল সমাজের নাগরীকরা জানায়,পথশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারী এবং বেসরকারী বিভিন্ন উদ্যোগ প্রয়োজন। স্কুল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া মানসিক ও শারীরিকভাবে পুনরুদ্ধারের জন্য পরামর্শ ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া জরুরি। সমাজের প্রতিটি মানুষের এগিয়ে আসা প্রয়োজন যাতে এসব শিশুদের জীবনের আলো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
এবিষয়ে ভৈরব রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: আবদুল আলীম সিকদার বলেন, পথশিশুরা অল্প বয়সেই নেশার কাজে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের কোন আদলতেও পাঠানো যায়না। সমাজ সেবা বা জেলা পদর্শন অফিসারদের মাধ্যমে এদের সংশোধনী কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: রেদুয়ান আহমেদ রাফি বলেন, বিভিন্ন সোসাল সেফটি এনজিও গুলো রয়েছে তাদের কার্যক্রমের আওতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে তারা যদি আমাদের ভৈরবের ছিন্নমুল শিশুদের নিয়ে কাজ করে। আমার মনে হয় সরকারের যে দায়িত্ব আছে পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থাগুলো এগিয়ে আসে তাহলে আমাদের জন্য তাদের নিয়ে কাজ করতে সহজ হবে।
ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের পথশিশুরা আমাদের সমাজেরই অংশ, কিন্তু তাদের জন্য সমাজে স্থান নেই। তাদের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এজন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে যাতে এই পথশিশুরা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে।
Leave a Reply